জামালপুরে বিলুপ্তির পথে চিরচেনা বাবুই পাখির বাসা

দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন
0


মোঃ সাইদুর রহমান সাদী \

বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে বাবুই পাখি এক সময় একটি অত্যন্ত পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ নাম ছিল। তালগাছ, খেজুরগাছ কিংবা অন্যান্য উঁচু গাছের ডালে ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসা এক বিশেষ সৌন্দর্য যোগ করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায়, আধুনিকতার ছোঁয়া এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাবুই পাখি ও তাদের বাসাগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। 

বাবুই পাখি, যার বৈজ্ঞানিক নাম “Ploceus philippinus”, মূলত এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত একটি পাখি। এরা "বুননকারী পাখি" নামেও পরিচিত, কারণ বাসা তৈরির ক্ষেত্রে এরা অবিশ্বাস্য দক্ষতা প্রদর্শন করে। পাতা, ঘাসের আঁশ এবং অন্য প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে বাবুই পাখি এমনভাবে বাসা তৈরি করে যা ঝড়-বৃষ্টি বা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এ পাখি সাধারণত দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। একটি গাছের ডালে অনেকগুলো বাবুই বাসা একত্রে দেখা যেত। বাবুই পাখি প্রকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত এবং জীববৈচিত্র্যের এক অন্যতম প্রতীক। তবে এখন এ পাখি এবং তাদের বাসা জামালপুরে এক বিরল দৃশ্য হয়ে উঠেছে।

জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাবুই পাখি বিলুপ্তির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য, প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস : বাবুই পাখির প্রধান বাসস্থান ছিল তাল, খেজুর এবং নারিকেল গাছ। কিন্তু এই গাছগুলো এখন কেটে ফেলা হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় খেজুর রস সংগ্রহের প্রথাও প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাছগুলোর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। কৃষি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার পোকামাকড়ের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে, যা বাবুই পাখির প্রধান খাদ্য। তাছাড়া কীটনাশকের কারণে পরিবেশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, যা পাখিদের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাবুই পাখির প্রজনন এবং জীবনযাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বৃষ্টি, খরার অস্বাভাবিক চক্র এবং গ্রীষ্মের তীব্র তাপমাত্রা এদের বাসা তৈরির জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করছে। গ্রামীণ এলাকায় শিশুরা মজা করার জন্য বাবুই পাখির বাসা ভেঙে ফেলে। অনেক সময় পাখি ধরা বা তাদের বাসা সংগ্রহ করা হয় শখের বসে, যা বাবুই পাখির সংখ্যা কমার আরেকটি বড় কারণ।

জামালপুরে বাবুই পাখি এখন এক বিরল দৃশ্য। জেলার বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে চরাঞ্চলে, তাল এবং খেজুরগাছের সংখ্যা কিছুটা বেশি থাকায় এখনও অল্প সংখ্যক বাবুই পাখি দেখা যায়। তবে তাদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। স্থানীয় মানুষরা জানিয়েছেন, ১০ বছর আগেও এ পাখি বেশি সংখ্যায় দেখা যেত, কিন্তু এখন তা প্রায় হারিয়ে গেছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাবুই পাখির সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার বিষয়ে তারা অবগত। তবে এই পাখি সংরক্ষণের জন্য এখনও বড় ধরনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বাবুই পাখির বাসা শুধু তাদের নিরাপদ আশ্রয় নয়, এটি প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টিশীলতার উদাহরণ। একটি বাসা তৈরিতে বাবুই পাখি প্রায় দুই সপ্তাহ সময় নেয়। এরা প্রথমে একটি কাঠামো তৈরি করে, এরপর সেটি শক্তিশালী করে তোলে। বাসার নিচের দিকে একটি প্রবেশ পথ থাকে, যা নিরাপত্তার জন্য উপরের দিকে বাঁকানো। পাখি বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই বাসা তৈরির পদ্ধতি প্রকৌশলবিদ্যার এক অসাধারণ উদাহরণ।

বাবুই পাখি এবং তাদের বাসা সংরক্ষণে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। যেমন : তাল, খেজুর এবং অন্যান্য বড় গাছ রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামীণ এলাকায় এ গাছগুলো বাড়ানোর জন্য সরকারিভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষকদের এই বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। বাবুই পাখি সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় মানুষদের সচেতন করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে বিশেষ প্রচারণার মাধ্যমে এ বিষয়ে শিক্ষিত করা যেতে পারে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় বাবুই পাখি এবং তাদের বাসা ধ্বংসের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন। বাবুই পাখি নিয়ে গবেষণার জন্য বিশেষ সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। সেখানে পাখিদের প্রজনন ও বাসা তৈরির পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। বাবুই পাখি বিলুপ্ত হলে গ্রামীণ বাংলার একটি ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। এটি শুধু একটি পাখি নয়, বরং এটি আমাদের জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবুই পাখির বিলুপ্তি পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার একটি বড় ইঙ্গিত।

জামালপুরসহ সারা দেশে বাবুই পাখির বিলুপ্তি ঠেকাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতা এবং প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এই পাখি এবং তাদের বাসা সংরক্ষণ সম্ভব নয়। বাবুই পাখি আমাদের প্রকৃতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা শুধু পরিবেশগত নয়, বরং সাংস্কৃতিকভাবেও আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)