\ মোঃ রাশেদুর রহমান রাসেল \ |
কথা একটাই, আমাদের প্রয়োজনেই আজ বিপন্নপ্রায় নদ-নদী রক্ষা করা জরুরি।
কেননা, যে নদী আমাদের ভৌগোলিক সত্তার দিক থেকেই শুধু নয়, রূপসী বাংলার প্রকৃতিরও প্রধান অনুষঙ্গ; সেই নদী আজ চরম বিপন্ন-বিপর্যস্ত, পাশাপাশি অস্তিত্ব সংকটে দেশের অনেক নদ-নদীর প্রাণও ওষ্ঠাগত। এক গবেষণায় দেখা গেছে গত দুই দশকে দেশের নদ-নদীগুলোতে ভারী ধাতুর কারণে দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষতিপূরণের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে। তাদের গবেষণায় জানা গেছে, ২০০১-২০১০ সালে নদীতে যে পরিমাণ দূষণ হয়েছিল, সেই তুলনায় ২০১১-২০২০ পর্যন্ত দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। ঢাকার বুক চিরে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা সবচেয়ে বেশি দূষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে আরও জানা যায়— ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের নদ-নদীগুলোর বেশির ভাগে ভারী ধাতুর উপস্থিতি অনেক বেশি। আর্সেনিক, সিসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, লোহা ও ম্যাঙ্গানিজের গড় ঘনত্ব তিনটি ঋতুতে গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং গ্রীষ্মের মাসগুলোতে সর্বাধিক দূষণ হয়। ট্যানারি, টেক্সটাইল ও ইলেক্ট্রোপ্লেটিং কারখানাসহ শিল্পকারখানার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বুড়িগঙ্গা। আর অন্যান্য জেলায় দখলের মতো অপরিণামদর্শী কর্মকা- এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকসহ শিল্পবর্জ্যে নদ-নদীর দূষণমাত্রা ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, দেশের নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব সংকট কিংবা প্রাণোচ্ছলতা হারিয়ে যাওয়ার পেছনে শুধু বলবান চক্রের আগ্রাসী থাবা এবং দূষণের ছোবলই অস্তিত্ব সংকটের একমাত্র কারণ নয়; এর পাশাপাশি রয়েছে নদী শাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর ব্যর্থতাও।
উচ্চ আদালত দেশের নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু এরপরও নদ-নদীর অস্তিত্ব সংকট কাটাতে কিংবা এর সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফসলের জমি, যে মাটি থেকে আমাদের জোগান আসে প্রধান খাদ্যপণ্য ধান এবং অন্যান্য কৃষিজ পণ্য; সেই জমিতে অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদনব্যবস্থায়ও অভিঘাত লেগেছে নদ-নদীর বিপর্যস্ততার কারণে।
দূষণের পাশাপাশি ভাঙনের যে তান্ডব এর দায়ও সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না। তাদের নজরদারি-তদারকির পাশাপাশি দখল-দূষণ ঠেকাতে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থার ঘাটতির বিরূপ ফল আজকের এই দুরবস্থা। পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবাছু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ১ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরা-জিরানি খাল পরিচ্ছন্নতাকরণ অভিযান অনুষ্ঠানে যথার্থই বলেছেন, ‘পরিষ্কার নদী দেখেনি বর্তমান প্রজন্ম।’ দেশের নদ-নদীগুলোর সিংহভাগ যেভাবে বিষের আধার হয়ে উঠেছে তাতে শুভবোধসম্পন্ন যে কারও উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় থাকে না। প্রকৃতির ওপর তো বটেই, খন্ডিতভাবে দেশের নদ-নদীর স্বাভাবিক বয়ে চলার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে, এর বহুমাত্রিক বিরূপ মাশুল আমাদের দিতে হচ্ছে এবং দ্রুত এর প্রতিবিধান নিশ্চিত না করলে ভবিষ্যতে বহুমাত্রিক শঙ্কা কিংবা বিপদের ছায়া আরও কতটা প্রলম্বিত হবে, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদীর নাব্য বজায় রাখা অপরিহার্য তো বটেই, পাশাপাশি নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখা, দখল-দূষণ মুক্ত করা ইত্যাদি কর্মসূচি ইতোমধ্যে কম গৃহীত হয়নি; কিন্তু কার্যত সুফল মেলেনি। আমরা দেখেছি, দফায় দফায় এজন্য বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর কেটে গেলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন তো হয়ইনি, উপরন্তু অনিয়ম-অব্যবস্থাপনাই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
দূষণের উৎস জানার পরও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলো যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে পারেনি বরং যারা দূষণের হোতা তাদের সঙ্গে তারা যেন প্রতিকারের নামে ‘সাপলুডু’ খেলেছে। আমরা আশা করব, দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গঠিত অন্তর্ র্বতী সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এবং দূষণ তো বটেই দখলসহ আরও যেসব কারণে বেশির ভাগ নদ-নদীর মৃতপ্রায় দশা, এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে বিলম্বে হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। ইতোমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে, কিন্তু এখন লক্ষ্য থাকুক ক্ষতির পরিসর যেন আর না বিস্তৃত হয় এবং যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে কীভাবে নদ-নদীর প্রাণোচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা যায়। দেশের শাখা নদীগুলোর অবস্থা আরও বিপজ্জনক। আমরা আশা করব, নদ-নদীর সুরক্ষায় বিগত সরকারগুলোর আমলে যে উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি শুনেছি, বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা সেই বৃত্ত থেকে বের হয়ে এসে আমাদের জীবন্ত সত্তার ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে দিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।
নদী-জলাশয় ও জলাভূমি বাঁচাতে হবে, ঠেকাতে হবে দখল-দূষণ, এই দাবি সব সময়ের। আমরা নদী, জলাভূমি, জলাশয়গুলোর সুরক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় জলসম্পদের তালিকা তৈরির তাগিদ দিই। দূষণের কারণগুলো অচিহ্নিত নয়। যেহেতু কারণ জানা আছে, সেহেতু এর প্রতিবিধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সব পক্ষ যূথবদ্ধ প্রয়াস চালাবে কঠিন প্রত্যয়ে, এটাই প্রত্যাশা। জীবনের অধিকার সুপেয় পানিপ্রাপ্তির অধিকারের। বিশুদ্ধ পানি ও বাতাসের অধিকার না থাকলে জীবন বিপন্ন হতে বাধ্য। নদ-নদী ও জলাশয়ের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়ক্রমে দূষণ সংকট দূর করতেই হবে। সুপেয় পানি ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এমন সবকিছু বন্ধে নিতে হবে কঠোর অবস্থান। আমরা দূষণমুক্ত পরিষ্কার নদ-নদী দেখতে চাই এবং দূষণের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গহণ করতে হবে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, জামালপুর।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন