ছাইদুর রহমান ।।
জামালপুর সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নান্দিনা বাজারে সুদের কারবার জমজমাট হয়ে উঠেছে। এক শ্রেণীর মুনাফাখোর অর্থ লগ্নি করে রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়ে তুলছেন। পাশাপাশি এলাকাবাসীকে ঠকিয়ে অনেকেই গা ঢাকা দেয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে। দাদন ব্যবসায়ীদের চাপে অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই নি:শ^ হয়ে পথে বসেছেন।
নান্দিনা বাজারে সাধারণত: দাদন ব্যবসার শুরুটা হয় গত ৯০ এর দশক থেকে। তখনকার সময় নান্দিনা পশ্চিম বাজারে গড়ে উঠে আবুল কালাম ফাউন্ডেশন, আমিনুল ফাউন্ডেশন, ডামকোসহ বিভিন্ন নামের এনজিও। লোভনীয় সুদ বা মুনাফা দেয়ার কথা বলে স্থানীয়দের গ্রাহক করে তাদের কাছ থেকে সঞ্চয় আমানত সংগ্রহ করে। এরপর মোটা টাকা জমা হলে রাতের আধারে অফিস গুটিয়ে পালিয়ে যায়। গত ২০০০ সনের দিকে নান্দিনায় গড়ে উঠে সরকারী অনুমোদনহীন একাধিক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বিভিন্ন নামে সংস্থা। এক লাখ টাকার বিপরিতে মাসে ৫ থেকে ৮ হাজার সুদে অর্থ লগ্নির ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে। নান্দিনা একটি প্রাচীণ বাজার। এখানে শত শত ব্যবসায়ী ক্ষুদ্র ঋণের জালে আটকা পড়েছে। ব্যবসায় পূঁজির দরকার। তাই ব্যবসায়ীরা ছুটছেন স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট। দৈনিক কিস্তি, সাপ্তাহিক কিস্তি, মাসিক কিস্তিতে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করা হচ্ছে। ১০ লাখ টাকা খাঁটিয়ে প্রতি মাসে একেকজন দাদন ব্যবসায়ীর মাসিক আয় ৫০ থেকে ৭০-৮০ হাজার বা লাখ টাকা।
সরেজমিনে জানা গেছে, আর্থিক প্রয়োজনে বেকায়দায় পড়ে সুদ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ছে মধ্যবিত্ত পরিবার, কৃষক, বর্গা চাষী, স্বল্প আয়ের লোকজনসহ স্কুল, মাদ্রাসা, সরকারি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। তারা এই কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করতে গিয়ে বিপদে পড়ে বাধ্য হয়ে ঐ সব সুদ ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ১৫০-৩০০ টাকা ননজুডিশিয়াল সাদা ষ্ট্যাম্পে স্বাক্ষর বা টিপ দিয়ে এমনকি ব্যাংকের ব্ল্যাংক চেক দিয়ে টাকা নিতে হয়। আর এই সাদা ষ্ট্যাম্পে স্বাক্ষী নেওয়া হয় সুদ ব্যবসায়ীদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের এবং ইচ্ছে মতো সাদা ষ্ট্যাম্প পূরণ করে রাখেন কিংবা প্রয়োজন মতো লেখার জন্য ষ্ট্যাম্প ফাঁকা রাখেন।
আর বেকায়দায় পড়া ব্যক্তিদের সুদ ব্যবসায়ীদের চাপে জমির দলিল পত্রাদি, স্বর্ণালংকার, চাকরিজীবিদের মাসিক বেতনের চেকও বন্ধক রাখতে বাধ্য হচ্ছে সুদ ব্যবসায়ীদের কাছে। দৈনিক, সাপ্তাহিক এমনকি মাসিক ভিত্তিতে নগদ ঋণ দিয়ে দেড় থেকে দুই গুণ মুনাফা আদায় করে সুদ ব্যবসায়ীরা। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মহাজন ও ব্যবসায়ীরা বাৎসরিক, মাসিক, সাপ্তাহিক এমনকি দৈনিক ভিত্তিতে নগদ ঋণ দিয়ে দেড় থেকে দুই গুণ মুনাফা লাভ করছে। অপরদিকে, গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ বেঁচে থাকার তাগিদে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে সাধারণ মানুষ দিন দিন গরিব ও ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছে আর মহাজনরা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে।
এলাকাবাসী জানায় মানুষকে নিঃস্ব করে পথে বসানোর অন্যতম উপায় দাদন ব্যবসা। আর এখন সুদ মানুষকে নিঃস্ব করার মরণ ট্যাবলেট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে এ ব্যবসা জমজমাট ভাবে চলছে গ্রাম-গ্রামান্তরে। ফলে দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। মোটা টাকা সুদ দেয়ার কথা বলে এবং নিরিহ মানুষকে নি:শ^ করে গত ২০ বছরে নান্দিনা থেকে প্রায় শতাধিক ব্যক্তি কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা হলে তারা জানান ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া অনেক কঠিন। কিন্তু দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে চড়াসুদে ঋণ নেয়াটা মোটেও কঠিন নয়। কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হয়েছে বলে সংবাদ নেই। কেননা, কোনো একজন ব্যবসায়ী চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ঋণ নিলে লাভসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করাতে করতে সে শেষ হয়ে যায়। সময়মত ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তার উপর নেমে আসে নির্যাতনের ষ্টিমরোলার। স্থানীয়দের নিকট থেকে ঋণ নিয়ে মানুষ একদিকে যেমন নি:শ^ হয়েছে। ঠিক তেমনি দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে চড়াসুদ দেয়ার কথা বলে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে একাধিক ঋণ গ্রহিতাও এলাকা থেকে পালিয়েছে বলে জানা গেছে।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন