ছাইদুর রহমান \
রুপালী পর্দা নামটি শুনলেই মন আনচান করে উঠে। মনের গহিনে বার বার ফিরে আসে সোনালী দিনগুলোর কথা। নানা স্মৃতি। নানা রোমন্থন। কয়েক দশক আগেও জামালপুর শহরে আনন্দ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। প্রাচীণকালে এন্তেজার, কথাকলি, নিরালা, সুরভী ও মনোয়ার সিনেমা হল। জেলা শহরের বাইরে ছিল নান্দিনা বাজারে দুটি প্রেক্ষাগৃহ। এর একটির নাম ছিল ময়নামতি। অপরটির নাম ছিল অনন্ত । এছাড়াও সদরের তুলশীপুর বাজারে বিনোদন নামে একটি সিনেমা হল গড়ে উঠেছিল।
জামালপুর শহরে কথাকলি ও এন্তেজার এই দুটি প্রেক্ষাগৃহের অবস্থান ছিল পাশাপাশি। মাঝখানের দুরত্ব ছিল মাত্র ৫০ গজের মতো। পাকিস্তান আমলে কথাকলি ও এন্তেজার সিনেমা হল নির্মিত হয়েছিল বলে জানা গেছে। তৎকালে বাংলা, হিন্দি ও পাকিস্তানের উর্দূ ছবি এ দুটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতো। কথাকলি সিনেমা হলের রুপালী পর্দাটি রঙিন কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। শো-শুরুর আগ মুর্হুতে রঙিন পর্দাটি সরে যেতো। এছাড়াও ভিতরের দেয়ালের খাদে খাদে ছিল রঙিন ডিপবাতি। কথাকলি সিনেমা হলের নামের সাথে জায়গাটির নামকরণ হয় কথাকলি মার্কেট। যা জেলার সব মানুষ এখন কথাকলি মার্কেট নামে চিনে। কথাকলি মার্কেটে ওই সময়কায় ফটো স্টুডিও, রেডিও, ক্যাসেট, ভিসিআর,ঘরি ও চশমার দোকান। এর মধ্যে কয়েকটি ফটো স্টুডিও, ঘরির দোকান এখনো টিকে থাকলেও কালের বিবর্তনে রেডিও, ক্যাসেট, ভিসিআর এর কোনো দোকান নেই।
এন্তেজার সিনেমা হলের পর্দাটি ছিল বিশাল বড়। অর্থাৎ প্রেক্ষাগৃহের প্রশস্ততার সমান। ওই বিশাল রুপালী পর্দায় বাংলা ছাড়াও হিন্দি ও উর্দু ছবি দেখানো হতো। এন্তেজার সিনেমাস্কোব পর্দাটি ছিল সত্যি দেখার মতো। শহরের তমালতলায় রুপালী ব্যাংক সংলগ্ন ছিল এন্তেজার সিনেমা হলের প্রবেশের গলি। এই পথেই দর্শকরা এন্তেজার হলে গিয়ে ছবি দেখে আসতেন। তবে কথাকলি মার্কেটের ভিতর দিলে গলি ছিল সেই গলি দিয়েও এন্তেজার প্রেক্ষাগৃহে চলাচল করা যেতো। আমি নিজেও গিয়েছি সেই গলি দিয়ে। যতদূর জানা গেছে, ১৯৮৫ সনে অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় এন্তেজার সিনেমা হল।
দেশ স্বাধীন হবার পর নির্মিত হয় নিরাল সিনেমা হল। নিরালা সিনেমা হলের বছরের অধিকাংশ ছবি সারাদেশে প্রতি শুক্রবার মুক্তি পাওয়া নতুন ছবি একযোগে প্রদর্শিত হতো। দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়তো ছবি দেখার জন্য। নিরালা সিনেমা হলের সামনে ছিল একাধিক পানের দোকান। পান সিগারেটের পাশাপাশি দোকানগুলোতে বিক্রি হতো তখনকার নায়ক নায়িকাদের ভিউকার্ড, ঈদ শুভেচ্ছা কার্ড ও পত্রলেখার প্যাড। দূর দূরান্ত থেকে আসা দর্শকরা সিনেমা দেখার পাশাপাশি এসব কার্ড কিনে নিয়ে যেতেন।
১৯৮৩ সনে শহরের নদের পাড় সংলগ্ন এলাকায় লালু ভুল ছবির মাধ্যমে উদ্বোধন হয় সুরভী সিনেমা হল। ২০০৪ সালে আবাসন ব্যবসায়ীদের চক্করে পড়ে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় সুরভী সিনেমা হল। ২০১০ সালের দিকে মালিকানা দ্বন্দের বন্ধ হয়ে যায় জামালপুর শহরের আবেদন চক মার্কেটে অবস্থিত এক সময়ের বৃহত্তর ময়মনসিংহের আধুনিকতম সিনেমা হল কথাকলি। চলচ্চিত্রের ব্যবসায় মন্দার কারণে ২০১৪ সালের দিকে বন্ধ হয়ে যায় নিরালা সিনেমা হল।
জামালপুর সদরের নান্দিনা বাজারে অনুরোধ ছবির মাধ্যমে ১৯৭৮ সনে উদ্বোধন করা হয় ময়নামতি সিনেমা হল। এছাড়াও নান্দিনা পশ্চিম বাজারে ১৯৯৮ সনে ইতিহাস সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যসে উদ্বোধন হয় অনন্ত সিনেমা হল। কিন্তু ব্যবসা মন্দার কারণে ২০১২ সনে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় ময়নামতি সিনেমা হল। আর ২০১৪ সনে বন্ধ হয়ে পড়ে অনন্ত সিনেমা হল। তুলসীপুর বাজারের একমাত্র বিনোদন প্রেক্ষাগৃহটি মাত্র কয়েক বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায়।
জামালপুর শহরের অন্যান্য হল বন্ধের পর হলের অস্তিত্ব জানান দিয়ে শহরের ষ্টেশন রোডে চালু হয়েছিল মনোয়ার সিনেমা হল। এটি ছিল জামালপুর শহরের একমাত্র সিনেমা হল। কিন্তু সেটিও বন্ধ ঘোষণা করে মনোয়ার সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ। ওদিকে, জামালপুর শহরের শহীদ হারুণ সড়কে একটি বহুতল ভবনে একটি সিনেপ্লেক্স নতুনভাবে চালু করা হলেও দর্শক খরার কারণে নিয়মিত ছবি প্রদর্শন করা সম্ভব হয় না। এক কথায় জেলা শহরের বাইরে হাতে গুণা কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ কঠিন সময় পার করলেও জেলা সদরে কোনো সিনেমা হল নেই।
পুরনো দিনের সিনেমা দর্শক নান্দিনার বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, আগেকার দিনে সিনেমা হল ছিল একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। পরিবার পরিজন নিয়ে টিকেট কেটে সিনেমা দেখার জন্য মানুষের অভাব ছিল না। প্রতি বছর দুই ঈদে নতুন নতুন সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া হতো। দর্শকরা ঈদের নতুন সিনেমা দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। বছরের দুটি ঈদ যেন সিনেমা দেখার উৎসবের পরিণত হতো।
রফিকুল ইসলাম জানান, এখন মানুষ সিনেমা হলে ছবি দেখা কমিয়ে দিয়েছে। ঘরে বসেই ইউটিউবে এখন সিনেমা দেখা যায়। তাছাড়া ফেসবুক, টিকটকে মানুষ এখন বিনোদন গ্রহণ করেন। সব কিছু মিলিয়ে মানুষ এখন সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিয়েছে প্রায়।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন