সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেল |
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা দেশটির অর্থনীতির জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। সাম্প্রতিককালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এতটা বেড়েছে যে, তা ব্যাংক খাতের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে খেলাপি ঋণের হার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে, যেখানে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্রের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
এই ঋণ সমস্যার প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। গত ১৫ বছরে ঋণ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আইন পরিবর্তন করা হয়েছে, যা মূলত ঋণখেলাপিদের পক্ষে গিয়েছে। এসব পরিবর্তন ঋণখেলাপিদের ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং তাদের ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের ঋণ আদায় প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যদি এ সমস্যার সমাধান না করা হয়, তবে দেশের ব্যাংকিং খাত আরও সংকটে পড়তে পারে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। তবে ২০২৩ সালের জুনে তা বেড়ে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বগতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ প্রদানের সময় যদি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা হতো, তবে এ সমস্যা এড়ানো যেত বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষত, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা পরবর্তীতে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য প্রথমেই ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকারদের উচিত ঋণ বিতরণে সতর্ক থাকা এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠানকেই ঋণ দেওয়া। ঋণ প্রদানের সময় যথাযথ যাচাই-বাছাই না করাই ঋণ খেলাপির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ঋণ আদায়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রবণতাও এ সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। অতীতে বড় ঋণখেলাপিরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা নিয়েছে, যার ফলে তারা ঋণ পরিশোধ থেকে বেঁচে গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণ কমাতে এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশেষায়িত ব্যাংক যেমন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) এবং রাকাবের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করা উচিত। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানে উপযুক্ত নয় এবং তারা নিয়মনীতি ভঙ্গ করে বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে, যা খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে।
খেলাপি ঋণের আরেকটি কারণ হচ্ছেÑ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ঋণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না এবং অনেক ক্ষেত্রে অলাভজনক খাতে ঋণ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ বিতরণ বন্ধ করতে না পারলে, খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান কঠিন হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকিং খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
ঋণ মওকুফ, পুনঃতফসিলিকরণ এবং ঋণ অবলোপনের মতো বিষয়গুলো খেলাপি ঋণের সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকগুলোকে ঢালাওভাবে ঋণ মওকুফ কিংবা পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ বেড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গবেষণায় ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেওয়া এবং ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এছাড়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা গেলে, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা প্রকৃতপক্ষে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কোনো সুবিধা দেওয়া উচিত নয়, কারণ এতে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ঋণ প্রদান করতে আর্থিক খাত সংস্কার করতে হবে। এ সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
সর্বোপরি, দেশের ব্যাংকিং খাতকে সুস্থ ও স্থিতিশীল রাখতে হলে খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, যাতে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব ও সভাপতি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনী সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা, জামালপুর জেলা শাখা।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন