মোঃ রাশেদুর রহমান রাসেল |
মানুষের নৈতিক বিপন্নতার অনেকগুলো উপসর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হতে পারে খাদ্যপণ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা। হ্যাঁ, এখানে সচেতনভাবে বিপন্নতা শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ আজ খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার মাত্রা ও মাত্রিকতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মানুষের নৈতিকতা আর অবনমন পর্যায়ে নেই, এটি এখন বিপন্নতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি অধিদপ্তরসমূহের অভিযান কিংবা গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সূত্রে খাদ্যদূষণের যে নিত্যকার ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, তাতে মানুষ হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করতে বড় কষ্ট হয়। বস্তুত, সমাজ ও মানুষের মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপরাধ প্রবণতা বাসা বেঁধেছে। তারকাখচিত রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে গ্রামের একেবারে সাধারণ খাবারের দোকানেও ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। নামিদামি খাদ্যপণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকে বিএসটিআইয়ের নিবন্ধনহীন অবৈধ কারখানা—সবাই প্রায় একই ধরনের অপরাধে জড়িত। কারো হলুদের গুঁড়ায় হলুদ নেই তো কারো নেই লবণে আয়োডিন। কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ সয়াবিন তেল রিপ্রোডিউস করছে তো, কেউ নষ্ট খেজুর নতুন মোড়কে বাজারজাত করছে। বাদ যাচ্ছে কী কাঁচা মাছ, দুধ কিংবা সবজি? মুরগির মাংস ও মাছে এন্টিবায়োটিক, হলুদ ও লবণে সিসা, মুড়িতে হাইড্রোজ, মিষ্টিতে কাপড়ের রং, শাকসবজি-ফলমূলে ফরমালিনসহ শত শত প্রাণঘাতী পন্থা আমাদের সামগ্রিক খাদ্যব্যবস্থাকে চরম হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ কারণে ক্যানসার, লিভার সিরোসিসসহ নানারকম অসংক্রামক রোগে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত, যার মূল কারণ রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত খাদ্যগ্রহণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন (২০২৩) বলছে, দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে এবং কমেছে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু। এই পরিস্থিতির পেছনে ভেজাল খাদ্যেরও দায় অনেক। এটা তো গেল স্বাস্থ্যগত দিক। এটার আর্থিক দিক যদি নিরূপণ করা হয়, তবে সেটি হবে ভয়াবহ। যারা দেশের ভেতরে চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের আর্থিক ব্যয়ের তথ্য পাওয়া কঠিন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর সর্বশেষ (২০২১ সাল) তথ্যমতে, বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করতে যাওয়া রোগীর পরিবারের বছরে ব্যয় হচ্ছে ৪০০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
যে কোনো অপরাধ প্রশমনে সরকারের দায়িত্ব থাকে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ এবং সচেতনতা সৃষ্টি করা। আর সমাজ ও নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। পাশাপাশি ভেজাল খাদ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সচেতনভাবে ও সামাজিকভাবে বর্জন করা। কারণ জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতা ছাড়া শুধু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও তৎপরতায় এই বিপুল-বিস্তৃত মরণঘাতী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ নামে একটি আইন আছে। সেই আইনে বিষাক্ত দ্রব্যের ব্যবহার, তেজস্ক্রিয়, ভারী ধাতু ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যোপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিপণনসহ নিম্নমানের খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়াকরণ সহায়ক দ্রব্যের ব্যবহার, শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত তেল, বর্জ্য, ভেজাল বা দূষণকারী দ্রব্য ইত্যাদি খাদ্য স্থাপনায় রাখা, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ, বৃদ্ধি প্রবর্ধক, কীটনাশক, বালাইনাশক বা ওষুধের অবশিষ্টাংশ, অণুজীব ইত্যাদির ব্যবহার, বংশগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকৃত খাদ্য, জৈব খাদ্য, ব্যাবহারিক খাদ্য, স্বত্বাধিকারী খাদ্য ইত্যাদি খাদ্য মোড়কীকরণ ও লেবেলিং, মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয়, রোগাক্রান্ত বা পচা মাছ, মাংস, দুগ্ধ বিক্রয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা ভোজনস্থলের পরিবেশনসেবা, ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত, নকল খাদ্য উৎপাদন, বিক্রয়, সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের নাম, ঠিকানা ও রসিদ বা চালান সংরক্ষণ ও প্রদর্শন, অনিবন্ধিত অবস্থায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদি বিজ্ঞাপনে অসত্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য, মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রস্তুত, মুদ্রণ বা প্রচারসংক্রান্ত বিধিনিষেধের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
পাশাপাশি এ আইনের ব্যত্যয় হলে শাস্তির বিধিবিধানও বিধৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, এই আইনের অধীন জারি করা পরোয়ানা তল্লাশি, গ্রেফতার ও আটকের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান প্রযোজ্য হয়। এখানে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থাও রয়েছে। ন্যূনতম ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে এই আইনে। আর অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে অপরাধীকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে নিরাপদ খাদ্য আদালত। যদিও এই আইনের খসড়ায় প্রথমবার কেউ অপরাধ করলে সাত বছর এবং দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভেজাল প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কঠোর পন্থা অবলম্বনই শ্রেয় ছিল। Forbes ম্যাগাজিন If You Are A Manufacturer Of Adulterated Food Can You Face Fines And Jail? শিরোনামে ৯ জুন ২০১৫ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধের লেখক Bill Marler পেশাগতভাবে একজন আইনজীবী, যিনি খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করে থাকেন। তার সেই নিবন্ধ থেকে জানা যায়, Odwalla Inc. নামে একটি মার্কিন খাদ্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভেজাল খাদ্য বাজারজাতকরণের অপরাধে ১৯৯৮ সালে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ১.৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি ২০১৫ সালের আরেকটি উদাহরণের কথাও বর্ণনা করেছেন। যেখানে ConAgra Foods নামক একটি প্রতিষ্ঠান সালমোনেলা (একধরনের নেতিবাচক ব্যাকটেরিয়া) মেশানো পিনাট বাটার সরবরাহের কারণে ১১.২ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে বাধ্য হয়।
অথচ, জামালপুরবাসী প্রতিনিয়ত ভেজালে ভরা খাদ্য খেলেও দেখার নেই কেউ। আমরা চাই অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হোক।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন