সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেল |
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের সরকার পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। দেশের মানুষের এই সরকারের প্রতি প্রত্যাশা অত্যন্ত বেশি, বিশেষত জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে। সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
প্রতিটি সেক্টরে ইতিমধ্যে পরিবর্তনের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।কিন্তু সত্যিকার পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের সামগ্রিক চিন্তাধারারও পরিবর্তন প্রয়োজন। সমাজকে সুন্দর ও নিরাপদ করে গড়ে তোলার জন্য শুধু বাহ্যিক পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্তরেও পরিবর্তন আবশ্যক।
আমরা অনেকেই মুখে বলি, ‘এটার পরিবর্তন হওয়া উচিত, ওটার পরিবর্তন হওয়া উচিত। কিন্তু নিজেরা কি সেই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত? কিছুদিন পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার পর আমরা আবার পুরোনো পথেই ফিরে যাই।
যদি সত্যিকার অর্থে সমাজে পরিবর্তন চাই, তাহলে প্রথমে নিজেদের বদলাতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে নিজেদের সমাজটিকে নিজেরাই গড়ে তুলি, যেখানে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সবার জন্য নিশ্চিত থাকবে।
বিশেষত, সিটি সারভেইলেন্স বা সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন নিয়ে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো সারা ঢাকা শহরজুড়ে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি সম্ভব হয়নি।
কিছু এলাকায় সীমিত আকারে সিসিটিভি সিস্টেম চালু থাকলেও, দুঃখজনকভাবে এখনো কোনো শহরই পুরোপুরি সিসিটিভি সারভেইলেন্সের আওতাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সিসিটিভির এমন কার্যকর ব্যবস্থা আমরা এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি? এর পেছনে বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, এখন সময় এসেছে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার। ঢাকা শহরসহ দেশের প্রতিটি জেলা শহরকে সম্পূর্ণ সিসিটিভির আওতায় আনতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোকেও এ উদ্যোগে সহায়তা করতে হবে, যেন ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা শহরের নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
সিটি সারভেইলেন্স সিস্টেম চালু থাকলে প্রতিটি মানুষের চলাচল, গাড়ির গতি, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সহজেই মনিটর করা যেত। এমনকি গুম, খুন, রাহাজানির মতো গুরুতর অপরাধগুলোও সঠিক সময়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে, ঢাকা শহরসহ জেলা শহরগুলোকে আরো নিরাপদ করা সম্ভব হবে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা হতে পারে প্রতিটি ভবনের সামনে একটি করে আইপি (ইন্টারনেট প্রোটোকল) ক্যামেরা স্থাপন করা। এই ক্যামেরাগুলো ভবন মালিকদের উদ্যোগে স্থাপিত হলেও মনিটরিং এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সার্ভার সিস্টেমের ওপর, যা সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।
প্রতিটি আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনের সামনে উন্নত মানের আইপি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। ক্যামেরার অবস্থান এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে যাতে পুরো এলাকা পর্যবেক্ষণে থাকে। সরকার একটি কেন্দ্রীয় সার্ভার সিস্টেম তৈরি করবে, যেখানে প্রতিটি ক্যামেরার ভিডিও ফিড সরাসরি সংযুক্ত থাকবে। এই সার্ভারগুলো সুরক্ষিত এবং উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে পরিচালিত হবে, যাতে রিয়েল-টাইম মনিটরিং সম্ভব হয়। সার্ভারের স্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার খরচ সরকার বহন করবে। ফলে ভবন মালিকদের শুধু ক্যামেরা স্থাপনের খরচ বহন করতে হবে। সরকার সার্ভার সিস্টেমের মাধ্যমে পুরো শহরের সিকিউরিটি মনিটরিং করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ দমনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবে।
এই মডেলটি বাস্তবায়ন করলে অপরাধমূলক কার্যক্রম যেমন চুরি, রাহাজানি, গুম, ইত্যাদি রোধ করা আরো সহজ হবে। একই সঙ্গে শহরের প্রতিটি অঞ্চল সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকার ফলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। এতে নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের সঙ্গে জনগণের একটি সমন্বিত প্রয়াস গড়ে উঠবে, যা একটি আধুনিক ও নিরাপদ শহর গঠনে সহায়ক হবে।
আমাদের পূর্ববর্তী এবং বর্তমান সরকার উভয়ই বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন এবং সেখানে বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভাবনী সমাধান দেখেছেন। তবে কেন জানি, আমাদের দেশের সমস্যা সমাধানে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা প্রায়ই অনীহা প্রকাশ করি। এই প্রশ্ন শুধু সাধারণ জনগণের নয়, আমারও। আমরা কি পারি না? অবশ্যই পারি। শুধু দরকার সঠিক উদ্যোগ এবং সদিচ্ছা। পৃথিবীর প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রে পুলিশ স্টেশনগুলো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। আমাদের দেশের পুলিশ স্টেশনগুলোও যদি উদ্ভাবনী পদ্ধতি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘স্মার্ট’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তাহলে তা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন হবে না। বড় আয়োজনের প্রয়োজন নেই, বরং কিছু বুদ্ধি, পরিকল্পনা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি সম্ভব।
আমাদের অ্যাসোসিয়েশন বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে এই উদ্ভাবনী পরিকল্পনা বিনামূল্যে সরকারের কাছে প্রদান করা যায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সদিচ্ছা দেখায়, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের পুলিশ বাহিনী জনগণের আসল বন্ধু হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হবে।
পুলিশ বাহিনীর ব্যবহৃত সকল অস্ত্র ও সরঞ্জামের আধুনিকীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে ট্র্যাকিং এবং রিসিভ অ্যান্ড ডেলিভারি স্ট্যাটাস অটোমেশন করা সম্ভব। এই উদ্যোগের মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রম আরো স্বচ্ছ এবং কার্যকরী হবে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য ডিজিটাল সাইনেজের মাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম, ফোন নম্বর, দায়িত্ব এবং দৈনন্দিন কর্মবণ্টন সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা যেতে পারে। পাশাপাশি উদ্ধার হওয়া মালামাল, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ছবি এবং নামসহ সকল ধরনের তথ্য জনসাধারণের জন্য ডিসপ্লে করা হবে। এটি জনগণের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থা বাড়াতে সাহায্য করবে।
যেকোনো দুর্ঘটনা বা মামলার ছবি এবং ভিডিও সার্ভারে সংরক্ষণ করে রাখা হবে। মামলার নিষ্পত্তির সময় অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রদর্শন করার জন্য এই তথ্য ব্যবহৃত হবে। সামাজিক সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার জন্য এটি একটি সহজ এবং কার্যকরী উপায়।
পুলিশ স্টেশনগুলোতে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) অথবা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া সহজতর করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিউ মেশিনের মাধ্যমে ভিকটিমরা নির্ধারিত সময়ে পুলিশের কাছে যেতে পারবেন এবং এভাবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার প্রয়োজন হবে না। ভিকটিমরা কিউ মেশিনের মাধ্যমে তাদের অভিযোগ বা জিডি করার জন্য একটি নির্দিষ্ট নম্বর পাবেন। এটি তাদের একটি সুসংগত এবং সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়ায় পরিষেবা গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। ভিকটিমরা চাইলে অনলাইনে একটি ফর্ম পূরণ করে সাবমিট করতে পারবেন। এই ফর্মটি বাংলা অথবা ইংরেজিতে হতে পারে, যাতে ভিকটিমদের ভাষার ওপর নির্ভর করে সুবিধা হয়। যদি কোনো ভিকটিম বাংলা ভাষায় অভিযোগ করতে চান, তবে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে এবং এর বিপরীতও সম্ভব। এটি সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণে সাহায্য করবে এবং ভাষার বাধা দূর করবে। অভিযোগ দায়েরের পর পুলিশ অফিসাররা দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। এভাবে ভিকটিমরা তাদের সমস্যার সমাধান দ্রুত পেতে সক্ষম হবে। ভিকটিমদের অভিযোগের একটি অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং তৈরি করা যেতে পারে, যা পরে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বডি ক্যামেরা ও ড্যাশ ক্যামেরা প্রযুক্তির মাধ্যমে পুলিশের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
আধুনিক পুলিশ স্টেশনগুলোতে এই ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলে জনগণের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে এবং পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম আরো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জনগণের প্রতি পুলিশের সেবা প্রদানের মান উন্নত করবে এবং জনসাধারণের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
পাইলট প্রকল্প হিসেবে, ঢাকা শহরের পাঁচ থেকে দশটি পুলিশ স্টেশনকে আধুনিক স্মার্ট পুলিশ স্টেশনে রূপান্তর করা সম্ভব। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব ৩০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে। এই উদ্যোগটি গ্রহণ করলে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পুলিশের কার্যকারিতা বাড়ানো যাবে। সরকারের ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টামণ্ডলী যদি চায়, তাহলে এটি সম্ভব। আমরা চাই আমাদের দেশবাসীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব ও সভাপতি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনী সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা, জামালপুর জেলা শাখা।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন