সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেল |
দেশে ইটভাটার নির্মাণ নিয়ে যে আইনের অস্তিত্ব রয়েছে, সেটা যেন কাগজে লেখা বর্ণনামাত্র। অনেকটাই কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই এই প্রবাদের অবস্থা। কেননা এর বাস্তবায়ন তেমন একটা দেখা যায় না। আবাসিক এলাকা ও কৃষিজমিতে অবৈধভাবে ইটভাটা স্থাপনের ঘটনা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় বসে এসব অবৈধ কার্যক্রম চললেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। এর ফলে পরিবেশ ও কৃষির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসন রয়েছে নীরব।
২০১৩ সালে প্রণীত ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ অনুযায়ী কৃষিজমি, আবাসিক এলাকা কিংবা পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকায় ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনে ইটভাটার জন্য পরিবেশের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করেছে। অথচ ইটভাটার একটি বড় অংশই আইন ভঙ্গ করে চালানো হচ্ছে। এর ফলে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে, ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, জামালপুর জেলার ৭টি উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা সর্বমোট ১শ ২৩টি। আর এর মধ্যে লাইসেন্স নেই ১শ ১১টির। এরা আশপাশের কৃষিজমি থেকে উর্বর মাটি কেটে নিয়ে ইট প্রস্তুত করছে। যা আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ। এছাড়া বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাস নির্গত হওয়ার কারণে এলাকার পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে, গাছপালা মরে যাচ্ছে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের জমি হারিয়ে, ফসল উৎপাদনে ব্যর্থ হয়ে এবং বিষাক্ত পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ, এ নিয়ে প্রশাসনের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
এই পরিস্থিতি প্রশাসনের দায়বদ্ধতার অভাবকেই স্পষ্ট করে। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ক্ষমতার জোরে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে অবৈধ ইটভাটাগুলো চলেছে। তার প্রভাব জেলার কৃষি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মকভাবে পড়ছে। এই অচলায়তন ভাঙার জন্য প্রশাসনিক কঠোরতা প্রয়োজন। আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নমনীয়তা কিংবা ছাড় দেয়া যাবে না।
প্রশাসনকে এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব ইটভাটা আইন ভঙ্গ করে চলছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশের অবক্ষয় রোধে এবং কৃষির সুরক্ষায় অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করা জরুরি। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং অবৈধ স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন, তবেই এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। নতুবা এভাবে চলতেই থাকবে। যা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শুধু তাই নয় এই অবৈধ ইটভাটাগুলোকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজির ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এ বিষয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা শাসনামলে ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী জামালপুর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনও তিনি এই পদে বহাল আছেন।কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার জোরে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রহীন অবৈধ ইটভাটাগুলো চালু রাখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনকে ম্যানেজের কথা বলে অবৈধ ইট ভাটা মালিকদের কাছ থেকে প্রতি বছর ৬ লাখ টাকা করে চাঁদা নিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইটভাটা মালিকরা জানান।
তারা আরও জানান-ইটভাটার জ্বালানি হিসাবে কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহারের ব্যবস্থা ও আবাদী জমির টপ সয়েল ক্রয়ে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তা এই সমিতি দেখবে বলে বৈধ ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকেও প্রতিবছর ৪ লাখ টাকা হারে চাঁদাবজি করেছেন। ইটভাটায় চাঁদাবাজির বিষয়টি ছিলো ওপেন সিক্রেট।
আবাদী জমির টপ সয়েল বিনষ্ট এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করার কারণে পরিবেশের বিপর্যয় হবে জেনেও ফারুক চৌধুরী অবৈধ ইটভাটা মালিকদেরকে রাজনৈতিক শেল্টার দিয়েছেন। অনৈতিক পন্থায় বিগত ১৭ বছরে ইটভাটা মালিক সমিতির নামে ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী গং অন্তত দেড়শ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। চলতি মৌসুমেও সেই একই হারে মালিক সমিতি ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে জানায় কতিপয় ইটভাটা মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটার এক মালিক জানান, চলতি বছরের নভেম্বর মাস থেকে শুরু হবে মৌসুমের ইট পোড়ানো। তিনি আরও জানান, জেলায় ১শ ২৩টি ইটভাটা সচল আছে। মাত্র ১২টি ইট ভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে। অবৈধ ১শ ১১টি ইটভাটা মালিকরা প্রতিবছর ৬ লাখ টাকা হারে সমিতির ফান্ডে এই সতের বছরে মোট টাকা জমা দিয়েছেন ১শ ১৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর ১২টি বৈধ ইট ভাটা মালিকরা ৪ লাখ টাকা হারে সমিতির ফান্ডে ১৭ বছরে জমা দিয়েছেন মোট ৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এছাড়া প্রতিবছরই তারা আরও অতিরিক্ত ২ লাখ টাকা করে প্রতিটি ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে চাঁদা নিযেছেন বলে জানান। সেই হিসাবে ১শ ২৩টি ইটভাটা থেকে বিগত ১৭ বছরে আরও ৪১ কোটি ৮২ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন। এই সময়ে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির নামে মোট ১শ ৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হবার অভিযোগ উঠেছে। চাঁদাবাজির বিশাল অঙ্কের এই অর্থের সিংহভাগই ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী গং নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইট ভাটা মালিকদের অভিযোগ।
আরও অভিযোগ রয়েছে, জেলার সাতটি উপজেলায় স্থাপিত ইটভাটাগুলোর বেশিরভাগ ফসলি জমির মাঠে তৈরী করা হয়েছে। প্রতিটি ইটভাটা মালিক পার্শ্ববর্তী ফসলি জমির টপ সয়েল সস্তায় ক্রয় করে ইট তৈরীর কাজে ব্যবহার করায় ফসলি জমির উর্বরতা হারাচ্ছে। এতে ফসলি জমির উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে প্রতিনিয়তই। ইট পোড়াতে কাঠ ব্যবহারের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন চলছে। সেই কাঠ ইটভাটায় বিগত দিনে ব্যবহার হয়েছে এখনও হচ্ছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে উঠা অবৈধ ইটভাটাগুলো পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। তাই জামালপুরের পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে অবৈধ ইটভাটাগুলি কাল বিলম্বব না করে বন্ধ করা জরুরি।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে ও সভাপতি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনী সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা, জামালপুর জেলা শাখা।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন