ব
সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেল |
লা বাহুল্য, আমরা বাংলাদেশীরা বরাবরই আধিপত্যবাদী চেতনাপ্রসূত প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির শিকার হয়ে এসেছি। কিন্তু আমরা চাই এই দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে।
অথচ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের লালিত প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি প্রসূত আধিপত্যবাদী চিন্তা চেতনা। আর তারা তাদের আখের গোছাতে যেসব স্বপ্ন দেখানো প্রয়োজন তাই করেছে এবং তাতে রাজনৈতিক গলাবাজি যোগ করা হযেছে। আর সেগুলো যে গালগপ্পের ফুলানো ফাঁপানো ঢাউস সাইজের ফানুস ছিল সেটা জাতি এতোটাদিন জিম্মিদশায় পার করে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছে। তাদের মিথ্যাচার ছিল প্রতিটি মেগাপ্রকল্পের জন্যই। এ কারণে ১০ হাজার বা ১২ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় শেষতক গিয়ে পৌঁছেছে ৩২ হাজার কোটিতে। টানেল নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু সেই ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে ১১-১২ হাজার কোটি টাকায়। দেশের প্রতিটি মেগাপ্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদনেই মূলত ফাঁপানো হয়েছে আসল আর নকলের মধ্যে। বাস্তবায়নের পর যে ফারাক দেখা যাচ্ছে, তা ওই দৃশ্যমান প্রকল্পের মতোই বিপুল। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রাম উড়ালসড়কের ব্যয়ের যে সমীক্ষাজাত হিসাব, সেখানেও গরমিল প্রায় তিন-চার গুণ। চীনের টাইহুর টানেলটি সমুদ্র তলদেশের ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে। ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টানেলটি প্রতি কিলোমিটারের ব্যয় যদি এক হাজার ৫শ ৯০ কোটি টাকা হয়, ভারতের মুম্বাইয়ের কোস্টাল রোড প্রকল্পের অধীন দুই কিলোমিটার তলদেশের টানেল নির্মাণ ব্যয় যদি এক হাজার ৭শ ৭৯ কোটি টাকা হয়, তাহলে কোন যুক্তিতে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণে ব্যয় প্রতি কিলোমিটারে হবে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা? হয় তখনই, যখন প্রকল্পের স্বাপ্নিক সেই প্রকল্পকে তাঁর দুর্নীতির একটি উৎস হিসেবে পরিণত করেন। সরকার পতনের পর একে একে ধরা পড়ছে হাসিনার মিথ্যাচারের সঙ্গে টাকা পাচারের পরিকল্পিত মেগাপ্রকল্পগুলোর নাম। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের ব্যয় কত ডাবল করেছে বিগত লুটেরা সরকার, তা খতিয়ে দেখলেই পাওয়া যাবে। এবং আমরা চাই প্রতিটি মেগাপ্রকল্পের ব্যয়ের প্রকৃত হিসাব এই সরকার বের করে জাতির সামনে তুলে ধরুক, যাতে আর কোনো সরকার এমন লুটের কাজ করার সাহস না পায়। তবে আমরা তো ভুলো-জাতি, খুব সহজেই সব কিছু ভুলে যাই। হাসিনার ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে যে পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন তিন-চার বছরে, তা তাঁকে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যবসায়ী দাবি করা হলেও বাস্তবে তা সম্ভব নয়। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ১৫০টি স্থাবর সম্পত্তি কেনা কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব নয়। এতে প্রাথমিকভাবেই ব্যয় হয়েছে ১৫০ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড। এই বিপুল অর্থ যে বাংলাদেশ থেকে পাচার করে নেওয়া হয়েছে এবং এর পেছনে যে তাঁর সরকারপ্রধানই জড়িত ছিলেন, সেটিও বেরিয়ে আসবে নিশ্চয়। তাদের মূল পরিকল্পনা কেবল টাকা লুটে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত ছিল না, তাঁরা স্বপ্ন নির্মাতা ও সেসবের সফল মার্কেটিংও করেছেন দেশবাসীর মনে আশা জাগিয়ে। তারা দৃশ্যমান প্রকল্প বাস্তবায়নে ও তা উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়েছেন যে তারাই কেবল উন্নয়ন করতে পারেন। কিন্তু তারা তো এটি পরিষ্কার করেননি যে তাঁদের শাসনামলে মাত্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা তিনি চাপিয়ে দেশের অর্থনৈতিক কোমরে ক্ষত সৃষ্টি করেছেন। ওই ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাংলাদেশ পরিশোধ করবে কেমন করে? বঙ্গবন্ধু টানেলের কথাই ধরা যাক। সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এই টানেল দিয়ে যে পরিমাণ গাড়ি চলবে, তা দিয়েই শোধ করা হবে এর ঋণ। কিন্তু প্রকৃত চিত্রে উঠে এসেছে ভিন্ন কিছু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যানুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে এই টানেল দিয়ে দৈনিক ১৭ হাজার ২শ ৬০টি যানবাহন চলাচল করতে পারবে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী বছরে ৭৬ লাখ যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৫ সালের পর থেকে টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯শ ৪৬টি। টানেলের লাইফটাইম ১০০ বছর।
শেষ করি একটি উপাত্ত দিয়ে, তাহলে বোঝা যাবে আওয়ামী ঘরানায় কত শত গোয়েবলস বসে আছে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় হাসিনার বিরুদ্ধে থাকা লোকজন বা মিছিলকারীরা মেট্রো রেলের দুটি স্টেশন পুড়িয়ে দেয়। অনেকেরই বিশ্বাস যে ওই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আওয়ামী ঘরানার রাজনৈতিক বাস মালিকরা। তাঁদের বাসের ব্যবসায় ধস নামবে—এটি বুঝতে পেরেই মেট্রো রেলের কাজকে তারা উৎসাহিত করেননি। এবং হাসিনার উদ্বোধনের রোগের কারণে ছয়টি লাইনের মধ্যে মাত্র একটির বেশির ভাগ সম্পন্ন না হতেই তিনি মহাসমারোহে উদ্বোধন করেন। যেমনটি তিনি করে গেছেন শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করে। এই বিমানবন্দরটির নাম সংক্ষিপ্ত করলে দাঁড়ায় হাসিনা। শাহজালালের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তিনি জিয়ার নাম বাদ দিয়ে ওই নাম রাখেননি। তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের পর লোকজন বলতে শুরু করল, তাহলে কি হাসিনার দিন শেষ? না হলে তিনি এতটা পাগল হয়ে উদ্বোধন করছেন কেন? মেট্রো রেলের কাজীপাড়া স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়ার পর সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, ওই দুটি স্টেশন সারাই করতে ২০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তাঁদের বিদায় হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ৫০ লাখ টাকায় একটি স্টেশন রিপিয়ার করেছে। ২০ কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাবটি গোয়েবলসীয় এবং সব মেগা ও অমেগা প্রকল্পের ব্যয়ও মিথ্যায় ভরা। মিথ্যা দিয়ে রাজনীতি হয় না। অসহিষ্ণুতা আর দমন-পীড়নের রাজনীতির অবসান করতে হবে। আমার ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে ওবায়দুল কাদের যে রণহুংকার দিয়েছিলেন, সেই ছাত্রলীগকে তো তাঁরা সন্ত্রাসী বাহিনীতে রূপান্তর করেছিলেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সন্ত্রাস, রণহুংকার ইতরতর ভাষার ব্যবহার, হেয় করার নিম্নমানের বক্রোক্তি চলে না। আওয়ামি লীগ কি সেটি জানে? সেটি কি বুঝতে পারবে? মনে হয় পারবে। আবার মনে হয় পারবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ এইচ মুসলিম হলে একটি ছেলেকে যারা পিটিয়ে হত্যা করেছে, তাদের ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই ছাত্রলীগের কর্মী। গত ১৫ বছরেই কেবল নয়, শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বরকন্দাজ ছিলেন একসময়কার ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুল কাদের।
এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে সকল দলের নেতাকর্মীদের বেরিয়ে আসতে হবে। শুরু করতে হবে সুস্থ, স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি। ওই ধরনের মাস্তানির রাজনীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতি, প্রতিশোধের রাজনীতির ডালপালা কেটেছেঁটে নতুন রাজনৈতিক পথযাত্রায় নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্ন দেখাক রাজনৈতিক দলগুলো আর সেই স্বপ্নে বিভোর জাতি এই আশাতে বুক বেধে আছে। জাতির পরিবর্তিত মানসিকতা বুঝতে ভুল করলে মাশুল দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তাই নিজেদের শোধরানো জরুরি। আর এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন