\ সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেল \ |
বৈষম্যবিরোধী চেতনায় দূর্বার তারুণ্য যেন বরাবরই নির্ভয়ে নির্মোহ সত্যজয়ের লড়াইয়ে যুক্ত হয় এই প্রত্যাশা সকল দেশবাসী সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমিও পোষণ করি।
কিন্তু বিগত নৈরাজ্যকর এক বন্দী পরিস্থিতিতে সামাজিক তারুণ্য মনে হচ্ছিল অনুপস্থিত, যেন হারিয়েই গেছে, অথচ সেই শঙ্কাকে মিথ্যে প্রমাণ করে সব্যসাচী তারুণ্যের বিদ্রোহ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এর ফলে এমন একটি সরকারের পতন ঘটল, যেটি স্বৈরাচারের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবং আশা করছিল কমপক্ষে আরো ১৫ বছর জাতির ভাগ্যাকাশে জগদ্দল পাথরের মতো আসীন থাকবে। আর সবদিক বিবেচনায় সে ব্যবস্থা মোটামুটি পাকাপোক্তই করে ফেলেছিল। তারুণ্য শুধু যে বিদ্রোহই করেছে তা নয়, সৃজনশীলতাও দেখিয়েছে। সরকার পতনের পর তিন-চার দিন রাজধানীতে কোনো ট্রাফিক পুলিশ দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে; ছেলেরা ছিল, মেয়েরাও এসেছে। তারপর এলো ভয়াবহ এক বন্যা। তখন দেখা গেল তরুণরা ত্রাণেও কেমন উদ্ভাবনশীল ও সমর্থ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা রাত-দিন ত্রাণ সংগ্রহ করেছে, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাপীড়িত মানুষের কাছে ছুটে গেছে। ছেলে-মেয়েতে কোনো পার্থক্য ছিল না, ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি মনে হয়েছে মিথ্যা প্রচারণা। বন্যার বিরুদ্ধে পাল্টা এক বন্যা, ধ্বংসের বিরুদ্ধে সৃষ্টির। বলা বাহুল্য, মানুষ এখন একে অপরকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়; আস্থায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ; কিন্তু শিক্ষার্থীদের ত্রাণের উদ্যোগে মানুষের আস্থা দেখা গেল অতুলনীয়। নগদ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে শত শত মানুষ ছুটে এসেছেন। কে কার আগে দান করবেন তার প্রতিযোগিতা।
মানুষ কাজ চায়, শুধু জীবিকার নয়, মানুষ জীবনের কাজও করতে প্রস্তুত; জীবনের কাজটা সমাজবদলের। অভাব যার, সেটি হলো আন্দোলন। ওই আন্দোলন বুর্জোয়ারা করবে না, বুর্জোয়ারা বৈষম্যবিরোধী নয়, তারা বৈষম্য সৃষ্টি ও লালন-পালনের পক্ষে; আন্দোলন করতে হবে বৈষম্যবিরোধীদের, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীদের।সমাজতন্ত্রীরা যদি একটি সুনির্দিষ্ট ও অতীব প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে, তবে দেখা যাবে সেই ফ্রন্টে মানুষ কিভাবে সাড়া দিচ্ছে এবং অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে পাঁচমিশালি একটি যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, তাতে মুসলিম লীগের পতন ভিন্ন অন্য কিছু অর্জিত হয়নি। এখন আর পাঁচমিশালি না, প্রয়োজন সমাজতন্ত্রীদের যুক্তফ্রন্ট। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্য সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য সমাজতন্ত্রীদের আবারও বলছে, মিলিত হতে, মিলিত হয়ে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব করে তোলার পথে এগোতে হবে। এই যুক্তফ্রন্ট জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে; ওই পথে সামাজিক বিপ্লব ঘটবে এই আশা নিয়ে নয়, সমাজ বিপ্লবের পক্ষে জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে জনমত এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। নির্বাচনের আগে দাবি হওয়া চাই প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন বণ্টনের এবং নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক উপাদান যুক্ত করার অধিকার দানের। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ঘোষণাটাও থাকা চাই যে বাহাত্তরের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত ছিল সংবিধানকে তা কোনোমতেই অমান্য করবে না।
পরিবর্তনকামীদের ঐক্যটা হবে সামাজিক বাস্তবতার পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এবং ঐক্য যতটা না নেতাদের হবে তার চেয়ে বেশি হবে কর্মীদের। দেশের মানুষ ওই ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ। বুর্জোয়াদের রাজনীতিতে তাদের আস্থা শেষ হয়ে গেছে। অভ্যুত্থানের আসল কাজটা অবশ্য তরুণরাই করেছে। বায়ান্ন এবং উনসত্তরের মতো এবারও। তরুণদের বয়স অল্প, তবে তারুণ্য যে বয়সনির্ভর এমনটা বলা যাবে না। তরুণরাও দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে যেতে পারে যদি তারুণ্য হারায়, আবার বৃদ্ধরাও তরুণ থাকতে পারে, যদি ভেতরে তারুণ্য থাকে। তারুণ্যের গুণ বিদ্রোহ, উদ্দীপনা ও সৃষ্টিশীলতা, যা এবারকার আন্দোলনে বিশেষভাবে দেখা গেছে। এতে তরুণদের সঙ্গে অন্য মানুষও যুক্ত হয়েছে, সেসব মানুষ, যাদের মধ্যে তারুণ্য টগবগ করছিল। তারা নানা পেশার, নানা বয়সের। অধিকাংশই অবশ্য অল্পবয়সী। সবাই তারা ছুটে এসেছে এবং ফ্যাসিবাদী একটি দুঃশাসনকে পরাভূত করেছে। গোপনে নয়, ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে নয়, প্রকাশ্য রাজপথে, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে, সমাবেশে ও মিছিলে সমবেত হয়ে।
আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল সাদামাটাভাবেই এবং ন্যায্য একটা দাবি নিয়ে। সেটা হলো সরকারি চাকরিতে কিছু গোষ্ঠীর জন্য বড় একটা ভাগ সংরক্ষিত রাখার বিদ্যমান বন্দোবস্তের পরিবর্তনের। সংরক্ষিত ভাগটা শুধু বড় নয়, ছিল খুব বড়, শতকরা ৫৬। এতে বাদবাকি চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছিল। সমস্যাটা ছিল মূলত শিক্ষার্থীদের জন্যই; শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে যারা চাকরির সন্ধানে নামবে বিশেষভাবে তাদের জন্য। শতকরা ৫৬টি চাকরি যদি নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠীই নিয়ে নেয়, তাহলে অন্যদের জন্য পাওয়ার সুযোগ আর কতটা থাকে?
কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত তরুণ কী চায়? কাজ চায়। কিন্তু কাজ তো নেই। উন্নতি হচ্ছে। বড় বড় অবকাঠামোর কথা শোনা যায়, দেখাও যায়, কিন্তু কর্মের সংস্থান কোথায়? এবারের আন্দোলনে ‘ভুয়া’ শব্দটা বেশ ভালোভাবে শোনা গেছে। শুরু করেছিলেন সরকারি দলের সর্বাধিক সরব এবং সর্বাগ্রগণ্য মুখপাত্রটিই। বিরোধী দলকে ভুয়া বলেছিলেন তিনি; শব্দটি ফেরত এসে তাঁকেই প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিল যখন নিজের দলের নেতাকর্মীরা তাঁকেই এবং তাঁর আশপাশের কয়েকজনকেও ‘ভুয়া’ বলে হাঁক ছাড়ল। কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলনকেও সরকারের অদম্য ওই মুখপাত্রটি ভুয়া বলেছিলেন; ভেবেছিলেন এটি একটি ‘খেলা’, যে কথাটাও তাঁর প্রিয়। এর আগে চ্যালেঞ্জ দিয়ে রাজপথে খেলতে ডেকেছিলেন বিরোধী দলকে। তিনি ভেবেছিলেন ওই দুই অভিধা ছাত্রদের আন্দোলনের বেলায়ও খেটে যাবে। বিরোধী দল বিএনপিকে হামলা, মামলা, জেল দিয়ে এবং পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে যেভাবে শায়েস্তা করেছিলেন একই কৌশল ছাত্র দমনেও কাজে লাগবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল আন্দোলনটি ভুয়াও নয়, খেলাও নয়; নির্ভীক লড়াকু সংগ্রাম বটে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর ওই মুখপাত্র দম্ভ ভরে বলেছিলেন, ছাত্রদের শীতল করতে তাদের ছাত্রসংগঠন, ছাত্রলীগই যথেষ্ট। অর্থাৎ বিএনপিকে ছত্রভঙ্গ করতে যত দূর যাওয়াটা দরকার পড়েছিল ততটাও যেতে হবে না; পুলিশ লাগবে না, প্রিয় ছাত্ররাই কাজটি সুসম্পন্ন করতে সক্ষম হবে; আন্দোলনকারীরা প্রথমে ভয়ে বরফ হয়ে যাবে, পরে গর্জনের উত্তাপে গলে পানিতে রূপান্তরিত হবে। ছাত্রলীগকে শাসকদলের সশব্দ পিঠ-চাপড়ানো বিফলে যায়নি, তারা লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক, রামদা, তলোয়ার ইত্যাদি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যুবলীগও বসে থাকেনি। স্বেচ্ছাসেবক লীগও উপস্থিতি জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ তো ছিলই। দু-চারজন তো বন্দুকই উঁচিয়ে রেখেছিল, প্রয়োজনে কাজে লাগাবে বলে। পুলিশকে সামনে রেখে আওয়ামীপন্থীরা পেছন থেকে গুলি যে ছোড়েনি এমনও নয়। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ছাত্রলীগ পারল না। তাদের দলের সবাই যে এসেছে তা অবশ্য নয়; পিটুনির হাত থেকে গা বাঁচাতে মিছিল ও সমাবেশে যারা আসত তাদের অনেকেই আসেনি।
পদত্যাগকারী ‘লৌহমানবী’ প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন শাসকদের পুরাতন ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি প্রয়োগ করতে, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের বহুল ব্যবহৃত বিভাজনটা নতুন করে সামনে নিয়ে আসতে। এক বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি যখন আন্দোলনকারীদের প্রকারান্তরে রাজাকারের নাতি-পুতি বলে ফেললেন তখন তারুণ্য আর বাঁধ মানেনি, মধ্যরাতেই শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসেছে। ছাত্রীরাও আওয়াজ তুলেছে আবাসিক হল-হোস্টেলে : ‘চাইতে এলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ আর এই যে মধ্যরাতে শত শত ছেলেমেয়ে সাহস করে সরবে বের হয়ে এলো তার কারণ শুধু যে কোটা সংস্কারের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার তা নয়, প্রধান কারণ তরুণের অন্যায়বিরোধী বিদ্রোহী-চেতনা। রাষ্ট্রের শাসকরা মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। তরুণ দেখেছে। তরুণদের জন্য সবচেয়ে বড় অত্যাচারটা ছিল অপমান। তরুণরা অপমানিত হচ্ছিল। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের পদে পদে অপমানিত করত। দমিয়ে দাবিয়ে রা খত। অনবরত ভয় দেখাত। বস্তুত ভয়ের একটি সর্বগ্রাসী সংস্কৃতিই তারা গড়ে তুলেছিল। রাজাকার বলে গাল পাড়ার ঘটনা তরুণদের আত্মসম্মানবোধের তপ্ত বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারুণ্য ভয়ের সংস্কৃতির নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ফেলেছে। এটা সেই তারুণ্য, যাকে দেখা গিয়েছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মধ্যে, বুক পেতে যে দাঁড়িয়েছে পুলিশের সামনে। ওই তারুণ্য আমরা শহীদ নূর হোসেনের বুকে দেখেছি, দেখেছি শহীদ ডা. মিলনের ভেতরে। উনসত্তরে দেখতে পেয়েছিলাম শহীদ আসাদ ও শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার মধ্যে। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রীর নামের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তাঁর স্বৈরাচারী আচরণ। বলা হয়নি হাসিনা তুই কবে যাবি, বলা হয়েছে ‘স্বৈরাচার তুই কবে যাবি।’ হাসিনার সবচেয়ে বড় অপরাধ ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন। হাসিনা ছিলেন ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থারই প্রতিনিধি। আন্দোলন কোটা বিরোধিতায় সীমিত থাকেনি, হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী। সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার নামও বদলে গিয়েছিল, বিবর্তিত হয়ে নাম নিয়েছিল ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলনের। এখন সময় দেশ গড়ার। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এসময়টাতে জয়কে ধরে রাখতে হবে নির্মোহ ও সদা সতর্ক থেকে তারুণ্যের বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে। মনে রাখতে হবে সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ দিতেই হবে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব।
সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন