বন্যা পরবর্তী কৃষি উৎপাদনে যথাযথ প্রণোদনা সহায়তা প্রদান জরুরি

দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন
0

 \ সৈয়দ মুনিরুল হক নোবেল \ 

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যার কবলে আমাদের দেশের ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকা আক্রান্ত হয়। প্রবল বন্যায় এসব জেলার অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। কৃষিজমি, বসতবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। মাছ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু ভেসে গেছে। এই বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ভাসিয়ে দিয়েছে এই অঞ্চল এবং মানুষগুলোকে করেছে নিঃস্ব ও সহায় সম্বলহীন। সাধারণত বন্যা হয় স্বাভাবিক বর্ষাকাল অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। কিন্তু এবারের বন্যা হয়েছে শরতের শুরুতে। এই সময় খাল, বিল, ডোবা, নদী, পুকুর এমনিতেই পানিতে ভরা থাকে। এবার এই সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত, সমুদ্রে নিম্নচাপ, দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, নদী-খাল দখলের কারণে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হওয়া এবং তার ওপর পার্শ্ববর্তী দেশের বাঁধের কপাটগুলো খুলে দেয়ায় অতিরিক্ত পানি যোগ হয়ে পানিরপ্রবাহ বেড়ে যায়, এতে বন্যার তীব্রতা বেড়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। এবারের বন্যায় কৃষিতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বন্যার্ত এলাকার কৃষিকাজ এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কৃষির পুনর্বাসন এখন সময়ের দাবি। প্রথমে বসতবাড়িকে কেন্দ্র করে কৃষি পুনর্বাসন এর কাজ শুরু করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো উক্ত এলাকার কৃষক ভাইদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদান করা এবং প্রণোদনা সহায়তা জরুরি। বন্যার পানি কমার পর এবং বসতবাড়ির আশেপাশের জায়গাগুলো আগে দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থায় বসতবাড়ি কেন্দ্রিক কৃষিতে গুরুত্ব দিয়ে কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। এই সময়ে তাদের সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগতভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া খুবই জরুরি বলে মনে করছি। দুর্গতদের যেহেতু চারা উৎপাদনের সুযোগ নাই, তাই বাইরে থেকে তৈরি সবজির চারা যেমন লাউ, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, সিম, টমেটো, মরিচ, বেগুন ইত্যাদির চারা পলিব্যাগে তৈরি করে তাদের সরবরাহ করে সহযোগিতা করতে হবে। সবজির চারার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শাক ও সবজির বীজ সরবরাহ করা আবশ্যক। সবজির চারাগুলো বসতবাড়ির আঙিনায় এবং বসতবাড়ির আশপাশে সব উপযোগী জায়গায় লাগাবে। অবস্থাভেদে চারাগুলোকে সরাসরি মাটিতে, বস্তায়, পলিথিন ব্যাগে, প্লাস্টিকের ক্রেটে, মাটির চাড়িতে, কাঠের বাক্সে, কাটা ড্রামে, পুরনো টিনে অথবা কলার ভেলায় লাগানো যাবে। বাড়ির পাশে জলাবদ্ধ জমিতে যদি কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ আগাছা থাকে তবে ভাসমান বেড প্রস্তত করে ও সবজি লাগানো যেতে পারে। এ সময় বসতবাড়িতে সল্পমেয়াদি লাল শাক, পুঁই শাক, ডাটা শাক ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে। সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। বন্যা পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথা কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বন্যা দুর্গত এলাকার কাছাকাছি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ব কেন্দ্রগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বীজ সরবরাহের পাশাপাশি চারা তৈরি করে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করবেন বলে আমরা আশা করছি। এই কাজে আমরা বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার জন্য আহবান করছি। অনেকেই এই কাজে ইতোমধ্যে জড়িত হয়েছেন। যাদের সামর্থ্য আছে তারা দেরি না করে এখনই নিরাপদ কোন জায়গায় পলিব্যাগে অথবা বীজতলায় বীজ লাগিয়ে দিন যাতে সময় হলে চারা সরবরাহ করা যায়। ধান হলো আমাদের প্রধান ফসল। এবারের বন্যায় পাকা আউশ ধান, নতুন করে রোপন করা আমন ধান, আমন ধানের বীজতলা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির ক্ষেত, ফল গাছ, মশলা ও তেল জাতীয় ফসল পানিতে ডুবে গেছে। যতই সময় যাবে ততই ফসলি জমিগুলো দৃশ্যমান হতে থাকবে। জমিগুলোতে আগাম রবি মৌসুমের শাকসবজি চাষের দিকে মনোযোগী হতে হবে। আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদন বিষয়ে সরকারকে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ সময়ে জমি কর্দমাক্ত থাকার কারণে কাদায় হয় এমন ফসল উৎপাদনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। এ লক্ষ্যে বিনা চাষে লাগানোর উপযোগী মাসকালাই, খেসারি ও সরিষা লাগানোর দিকে নজর দেয়া যায়। কম খরচে ও কম বিনিয়োগে এটা লাভজনক কৃষি উৎপাদন বাবস্থা। এ সময় কৃষকদের জলামগ্নতা সহনশীল ধানের বীজ সরবরাহ করা প্রয়োজন। আমন ধানের চারা তৈরি করেও সরবরাহ করা যায়। বন্যায় ক্ষতি মোকাবেলার জন্য এ সময়ে চাষের উপযোগী জাতের আমন ধানের বীজের পর্যাপ্ত সংস্থান ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে এ বন্যায় রোপা আমনের বীজতলা পানিতে ডুবে যাওয়ার ফলে জমিতে লাগানো চারা নষ্ট হয়েছে, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে গুনগত মানসম্পন্ন বীজ না পাওয়ার সম্ভাবনা আছে অর্থাৎ বীজের সংকট হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বন্যা আক্রান্ত হয় নাই এমন জমির আমন ধানের গাছ থেকে ২-৩টি কুশি রেখে বাকি কুশিগুলো যত্ন সহকারে শিকড়সহ তুলে এনে বন্যা আক্রান্ত জমিতে লাগানো যেতে পারে। এতে মূল জমির ধানের ফলনে কোন তারতম্য হবে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় সার ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। চলমান ফসল আমনের পরই আসে বোরো ধানের চাষ। এখনি বোরো ফসল উৎপাদনের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বন্যার্ত মানুষেরা সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব। এ মুহূর্তে তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। যে কোন কাজে টাকার প্রয়োজন। টাকা হলো মানসিক শক্তি। সহজে অর্থনৈতিক সংস্থান হলে আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ঘুরে দাঁঙানোর শক্তি খুঁজে পাবে। বিভিন্ন এনজিও এ বিষয়ে কৃষকদের সহায়তা করতে পারে। কৃষকদেরকে সুদমুক্ত বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সময়ের সাথে সাথে কৃষিতে ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। এই ঝুঁকিতে আমাদের কৃষক ভাইয়েরা তথা উৎপাদনকারীরা সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাই উৎপাদনকারীদের স্বার্থ নিশ্চিতের লক্ষ্যে শস্য বীমা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে। উৎপাদনকারীদের স্বার্থ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা টেকসই কৃষি ভাবতে পারবো না। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কতা বিষয়ে আমাদের আরো সজাগ হতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে পানির যথাযথ বণ্টন বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি আমাদের বন্যা আক্রান্ত কোন জমি পতিত রাখা যাবে না। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কোন না কোন ফসল লাগাতে হবে।

লেখক :  বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সরকারি মিডিয়া (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত জামালপুরের প্রচারশীর্ষ দৈনিক-সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন অনলাইন ভার্সন । আপনার মতামত প্রকাশ করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট কুকি ব্যবহার করে থাকে। Check Now
Ok, Go it!